
ফরিদা ইয়াসমিন::
আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবার ও সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নারী-পুরুষে বৈষম্য, পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে নারীর অধিকার। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে নারী লিঙ্গীয় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিবাহ-বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার ইত্যাদিতে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড হামলা, শারীরিক-মানসিক নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী।
জাতিসংঘের একটি সূত্রমতে, প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওপর তার পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এমনকি শহরাঞ্চলেও ৬০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে মার খায়, ২০ শতাংশ যৌন হয়রানির এবং ৬৭ শতাংশ নারী মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়। আর অধিকাংশ নারী একে স্বামীর অধিকার বলেই মেনে নেয়। সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য নির্মূলে সমাজসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। অর্থাৎ সমাজকে জানাও, নারীকে জানাও তার অধিকারের কথা। নারীর জন্য সরকারের সুযোগ-সুবিধা কী, কোথায় পাবে নির্যাতিত নারী আইনি সহযোগিতা, কোথায় আছে তার শিক্ষার সুযোগ। সবই তাকে জানাতে হবে। এ তথ্য জানার অধিকার তার মৌলিক মানবাধিকার, তার জন্মগত অধিকার।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। রাষ্ট্রীয় নথিপত্রের মালিকও জনগণ। তথ্য অধিকার বা জানার অধিকার থেকে রাষ্ট্র জনগণকে বঞ্চিত করতে পারে না। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ যে কোনো মাধ্যম ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ ও জ্ঞাত করার স্বাধীনতা রয়েছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের প্রথম সাধারণ অধিবেশনে তথ্য জানার স্বাধীনভাবে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ তথ্য অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে জাতিসংঘ প্রথম থেকেই স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ও স্যাটেলাইটের কল্যাণে অনায়াসেই প্রবেশ করা যাচ্ছে তথ্যের বিশাল ভাণ্ডারে।
পৃথিবী পরিণত হয়েছে ইলেকট্রনিক গ্লোবাল ভিলেজে। বিশ্বের অবাধ তথ্যপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট গ্লোবাল ভিলেজ নারীকে মূলত আরও প্রান্তিক অবস্থানেই ঠেলে দিয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবে নারী ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। যোগাযোগের অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার যখন একদিকে প্রসারিত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীকে যুগের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও চর্চায় নারীকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন উদ্যোগের। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে নারী-পুরুষে ব্যাপক বৈষম্য। কারণ বরাবরই প্রযুক্তির সুবিধা আগেভাগে সুবিধাভোগীরাই পায়। ইন্টারনেট সারা বিশ্বকে আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এলেও এখানে নারীর প্রবেশাধিকার কতটুকু? এটাও ভেবে দেখার বিষয়। তথ্য জানার জন্য আমরা সাধারণত নির্ভর করি গণমাধ্যম তথা রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের ওপর। বর্তমানে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনলাইন মিডিয়া। তবে বিশাল এ তথ্যজগতে নারীর প্রবেশ কতটুকু? গণমাধ্যমে নারীর অবস্থা ও অবস্থান কী? বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গণমাধ্যমে নারী এখনো প্রান্তিক অবস্থানেই রয়ে গেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। সাংবাদিকতা পেশার শুরুর পর্যায়ে সাব-এডিটর বা স্টাফ রিপোর্টার পদে যে হারে দেখা যায়, পরবর্তী পর্যায়ে তাদের সংখ্যা খুবই কম। সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারী পৌঁছতে পারছে না।
দেশের জাতীয় পর্যায়ের সব দৈনিক মিলিয়ে এ সংখ্যা হাতে গোনা তিন থেকে চারজন। বেসরকারি পর্যায়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আত্মপ্রকাশের পর চ্যানেলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বেড়েছে। সেখানেও রিপোর্টারের চেয়ে নারী উপস্থাপকের সংখ্যা বেশি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়েও নারীর সংখ্যা এক থেকে দুজন। পুরুষ অধ্যুষিত ও পুরুষ নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে নারীকে একটি পর্যায়ে আটকে দেওয়া হয়। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীকে যেতে দেওয়া হয় না। তার পদোন্নতি দেওয়া হয় না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী না থাকার কারণে মূলত পত্রিকাগুলোতেও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবেরই প্রতিফলন দেখা যায়। সংবাদ পরিবেশিত হয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই।
অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য, অপরাধ ও সহিংসতা, রাজনীতি ও সরকার, সমাজ, আইন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ক্রীড়া ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অনেক বেশি সংখ্যায়। নারীর উপস্থিতি খুবই কম, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা শূন্যের কোঠায়।
সংবাদপত্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং নারী সংবাদকর্মীর সংখ্যা কম বলেই সংবাদপত্রে নারীবিষয়ক তথ্য তার প্রান্তিক অবস্থানেই রয়ে গেছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তির বদলে নেতিবাচক ভাবমূর্তি বেশি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। নারী পরনির্ভরশীল, নারী অধস্তন ইত্যাদি চরিত্রই সংবাদপত্রে বা বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে নারী হয়ে ওঠে পণ্য। শব্দচয়ন, ভাষার ব্যবহার বা ছবির ব্যবহারে জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়ার পরিবর্তে প্রতিবেদনগুলোতে জেন্ডার অসচেতনতাই প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ একটি জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় বলা হয়েছে- গণমাধ্যমে নারীর সঠিক ভূমিকা প্রচার, প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং অংশগ্রহণে বৈষম্য দূর করা, গণমাধ্যমে নারী ও মেয়েশিশুর অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং নারী ও মেয়েশিশুর ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটানো। নারীর প্রতি অবমাননাকর নেতিবাচক, সনাতনী প্রতিফলন এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যবস্থাপনা ও আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণে নারীর জন্য সমান সুযোগ রাখা এবং প্রচারমাধ্যম নীতিমালায় জেন্ডার প্রেক্ষিত সমন্বিত করা হবে। এখানে যদিও স্পষ্ট করে নারীর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গণমাধ্যম নীতিমালার কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি?
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর অবস্থান খুবই নাজুক, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে নারী ইস্যু পত্রিকার পাতায় গুরুত্ব পায় না। দু-একটি দৈনিক পত্রিকায় নারী ইস্যুতে রিপোর্ট করার জন্য একজন নারী রিপোর্টার নিয়োগ দিয়ে তারা নারীসমাজের জন্য যথেষ্ট করছেন বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। এখানে একটি কথা না বলে পারছি না। গণমাধ্যমে কোনো সেন্সরশিপ না থাকলেও সেল্ফ সেন্সরশিপের কবল থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছি না। কখনো নারীকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা হয়, কখনো বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ নারী। এ নারী পাঠককে ধরতে হলে নারীর কথা শুনতে হবে, নারীর কথা জানতে হবে, নারীকে বুঝতে হবে। বাড়াতে হবে নারী সংবাদকর্মীর সংখ্যাও। কারণ নারীর কথা ভালো বলতে পারে নারীই।
গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। কারণ প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের তথ্য জানার অধিকার আছে। অর্থাৎ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে তথ্য জানার ও পাওয়ার অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার একটি তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করেছে।
এ ছাড়া অতিসম্প্রতি সরকার জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা, ২০১৫ খসড়া প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশে অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিদ্যমান অবস্থায় এসব গণমাধ্যম কোনো স্বীকৃতি বা সুযোগ-সুবিধা পায় না। অন্যদিকে গণমাধ্যমের জাতীয় মান রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছে না। নীতিমালা অনুযায়ী সব অনলাইন গণমাধ্যমের সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, আর্থিক সংগতি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো অনলাইন মিডিয়া গড়ে উঠছে এটা সত্য। অনলাইন মিডিয়ার বিকাশ, এর গ্রহণযোগ্যতা ও সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনতে একটি নীতিমালা থাকতে পারে। তবে এ নীতিমালা অনলাইনের বিকাশের চেয়ে যেন প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায়। বিশেষ করে নারীদের বেলায়। অনলাইন গণমাধ্যম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন নারীও এ নতুন ধারায় বিনিয়োগ করেছেন। নারী সম্পদের উত্তরাধিকারী নয়, নারীর নিজস্ব সম্পদ নেই বললেই চলে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তথ্যজগতে নারী প্রবেশ করেছে অনেকটা বিনিয়োগকারী হিসেবেও। নারীর চোখে বিশ্ব দেখার প্রত্যয়ে অনেক নারীবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল চালু হয়েছে। যেমন উইমেনআই টোয়েনটিফোর ডটকম, উইমেন চ্যাপ্টার, উইমেন নিউজ ইত্যাদি। এসব নিউজ পোর্টালে নারী যেমন বিনিয়োগ করেছেন, নারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, নারীরাই লিখছেন। নারীসংক্রান্ত খবর, নারীদের উন্নয়ন ও সম্ভাবনার কথা তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছেন। তথ্যের অবাধ প্রবাহে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। অনলাইন নীতিমালায় এমন কোনো কঠিন শর্ত আরোপ করা ঠিক হবে না, যে শর্তের বেড়াজালে নারী তার এ বিনিয়োগ থেকে ছিটকে পড়েন। শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। তাই নীতিমালায় এ বিষয়গুলোতে আপস না করে আর্থিক সংগতির ক্ষেত্রে যদি নারীকে একটা বিশেষ ছাড় দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো উইমেন নিউজ পোর্টালগুলো নির্বিঘ্নে পরিচালিত হতে পারে। এতে তথ্যের প্রবাহে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বৈকি।
লেখক : সাংবাদিক
পাঠকের মতামত